“উখিয়ার বুকে এক খন্ড বাংলাদেশ”

আমানত উল্লাহ সাকিব :

উখিয়ার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ উখিয়া কলেজ। ১৯৯২ সালে গহিন অরণ্য (দিনদুপুরে ও যেখানে হাতির ভয় ছিল,সে রকম পাহাড় ঘেরা পথে) কিছু স্বপ্নচারী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উখিয়ায় প্রথম কলেজ উখিয়া কলেজ। দীর্ঘ আড়াই যুগের মত সময় পাড়ি দিয়ে উখিয়া কলেজ আজ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিণত। ইন্টারমিডিয়েট নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে ৭টি ডিপার্টমেন্টে অনার্সসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্রছাত্রী নিয়ে দক্ষিণ কক্সবাজারের সবচেয়ে বৃহত্তম কলেজ হিসেবে সুনামের সাথে পাঠদান করে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বেও এই উপজেলার নাম দেশের অনেকে না জানলেও এখন আর কারো অজানা নয়।

দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বপরিমন্ডলে উখিয়া এখন বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। উখিয়ার আড়াই লক্ষ মানুষের স্বর্গভূমিতে এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রায় আট লক্ষ মানুষের বাস। আগত মেহমানদের সেবা দিতে দেশি-বিদেশি মিলে হাজার পঞ্চাশেক দেশীয় ও সাদা চামড়ার মিলন মেলা এই উখিয়ায়। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এই অঞ্চলের পরিবেশ, অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতির পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণটা খুবই ভয়াবহ। এই উখিয়াকে কেন্দ্র করে চলছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। রোহিঙ্গাদের যত্নের জন্য বিদেশি এনজিওগুলো কোটি কোটি ডলারের ডোনেশন দিচ্ছে, যার বেশিরভাগ অর্থ খরচ হচ্ছে বিদেশি অফিসারদের থাকা-খাওয়া ও মজা মাস্তিতে। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের বেশিরভাগ স্টার মানের হোটেল এখন বিদেশী এনজিও কর্তাদের দখলে। যেখানে প্রতিনিয়ত চলছে মদ, জুয়া, আর উচ্চ বেতনে চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে নারীর দেহ ভোগের জলসা।রোহিঙ্গারা আসার ফলে উখিয়ার মানুষ সামগ্রিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এনজিওগুলো উখিয়ার মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করতে আগ্রহী নয়।

রোহিঙ্গা আসার কারণে উখিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা আজ প্রায় বিপর্যস্ত। যার প্রথম স্বীকার উখিয়ার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ উখিয়া কলেজ।রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহের জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ( World Food Programme- WFO) প্রথম দখল করে নেয় উখিয়া কলেজের মাঠ। স্থাপন করে ২৬টি খাদ্য রাখার গোডাউন। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রেরণ করে সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনী এসে দখল করে নেয় কলেজের প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবন। ইমার্জেন্সি সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য আনা হয় বিজিবি’কে। তাদেরও ঠাঁই হয় উখিয়া কলেজে। অস্ত্রের গোডাউন আর সৈনিকদের থাকার ব্যবস্থার জন্য দখল করা হয় কলেজের সমস্ত ক্লাসরুম। ডাব্লিউএফপি’র খাদ্য গুদাম, সেনাবাহিনী ও বিজিবির নিরাপত্তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসের মেইন গেইটে স্থাপন করা হয় নিরাপত্তা চৌকি। কলেজে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বহন আর নিয়মিত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াটায় ছিল খুবই বিব্রতকর। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীদের আগমন কমতে শুরু করলো। কলেজের পরিবেশটাও কেমন যেন ভুতুড়ে হয়ে উঠল। দীর্ঘ ছ’মাস ব্যবহার করল উখিয়া কলেজ ক্যাম্পাস কোন রকম ভাড়া প্রদান ছাড়াই। পণ্য পরিবহন ও সৈনিকদের যাতায়াতের জন্য বড় বড় গাড়ি ব্যবহারের কারণে কলেজের মূল গেইট, রাস্তা, খেলার মাঠ প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। ক্লাসরুম, লাইট, ফ্যানগুলোও প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। ডাব্লিউএফপি তাদের ইমার্জেন্সি পিরিয়ড ভালোভাবে কাটিয়ে, সময় নিয়ে সুবিধামত স্থানে চলে গেলেও সরকারি সংস্থাগুলোকে হয়তো আবার আসতে হবে উখিয়া কলেজে।

যাদের মানবতা দেখাতে, যাদের খাদ্যের যোগান দিতে বিশ্বের বাঘা বাঘা এনজিও এবং আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো এখানে এসেছিল হয়তো একদিন তাদের হাত থেকে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আরো বেশি পরিমাণে সেনা ও বিজিবির সমাগম হতে পারে এই অঞ্চলে। আর উখিয়ায় যেহেতু মিয়ানমারের সাথে স্থলসীমান্ত, দুঃসময়ের জন্য উখিয়া কলেজই হবে সরকারের জন্য উত্তম রণমঞ্চ। তাই সরকারের উচিত হবে উখিয়া কলেজে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ এবং জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এসে ভবিষ্যত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখা। সরকার চাইলে এনজিওগুলোকে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই কলেজের ভবন নির্মাণ এবং শিক্ষার আধুনিক সরঞ্জামও সরবরাহ করাতে পারে। বাংলাদেশের এতগুলো কলেজ একসাথে জাতীয়করণের আওতায় আসলেও জাতীয় সমস্যায় ভুমিকা রাখা উখিয়ার এই বিখ্যাত কলেজ এবারেও বঞ্চিত। তার পরেও হতাশ নয় উখিয়া কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অবিভাবক ও উখিয়ার জনসাধরণ। তারা স্বপ্ন দেখে খুব দ্রুত জাতীয়করণের পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি মডেল কলেজে পরিণত হবে এই কলেজ। সম্প্রতি নিজেদের অর্থায়নে কলেজের সংস্কার কাজ হয়েছে। কলেজের প্রতিটি ভবনে লাল সবুজের রংয়ে ফুটিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের রক্ত খচিত মানচিত্র। এ যেন “উখিয়ার বুকে এক খন্ড বাংলাদেশ”।

আমানত উল্লাহ সাকিব
প্রভাষক, উখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ,
কক্সবাজার।

Leave a Reply